অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলংকা
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে ৩১ মার্চ, ২০২২ শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ ঠেকাতে ১ এপ্রিল, ২০২২ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কায় জ্বালানি পাম্পসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বাইরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। ৩ এপ্রিল, ২০২২ দেশটিতে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারসহ বিভিন্ন সামাজিক সেবা বন্ধ করে দেয় শ্রীলংকান সরকার অন্যদিকে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ব্যতীত ২৬ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভার সবাই একযোগে পদত্যাগ করেন।
বিপর্যয়ের কারণ
শ্রীলংকার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট কেবল পরিবারতন্ত্র বা অনুৎপাদনশীল বৃহৎ ভৌত অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য হয়েছে, এমনটি নয়। সংকটের অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে অহেতুক করহার হ্রাস, উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে মুদ্রা ছাপানো, অর্গানিক কৃষি চালু করতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, রেমিট্যান্স ও পর্যটনের মতো সেবা খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, ঋণ করে আলংকারিক ভৌত অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন। এর ফলে ঋণ জিডিপির অনুপাত ১০২ শতাংশে ও ঋণ পরিশোধের দায় ৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। করোনা মহামারির কারণে আরোপিত যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে ও রেমিট্যান্সে ভাটা পড়ে। ফলে রিজার্ভে ধস নামে। শ্রীলংকান রুপির অবমূল্যায়নের (প্রতি ডলার ১৯৮ রুপি থেকে ২৯০ রুপি) ফলে আমদানি ব্যয় বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়। ফলে ডিজেল, রান্নার জ্বালানি, সবজি, খাদ্যশস্য, ওষুধের সংকট দেখা দেয় এবং ঋণের দায় পরিশোধ অসম্ভব হয়ে পড়ে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ওঠে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস ও এর ফলে সাত-আট ঘণ্টা ব্ল্যাকআউট। এভাবেই সামগ্রিক অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় দেশটি এখন দেউলিয়াত্বের সম্মুখীন।
ঋণের ফাঁদে
শ্রীলংকার উন্নয়ন-দর্শনে ‘ঋণ করে হলেও ঘি খাও’ নীতি প্রতিফলিত হয়েছে। আর এ ঋণ দিতে এগিয়ে এসেছে চীন। হাম্বানটোটা আন্তর্জাতিক গভীর সমুদ্রবন্দরের কথাই প্রথম আসবে। শ্রীলংকার সাবেক ও বর্তমান প্রেসিডেন্টের বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে সমালোচকদের ‘এ প্রকল্প বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়’ মতামত উপেক্ষা করে এ প্রকল্প গ্রহণ করেন। যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শ্রীলংকা এক ঘরে, তখন ১৬-১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সফরে যান চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তার সফরকালেই প্রচুর ঋণ এবং বিনিয়োগের সূচনা হয়। ২০০৭-২০১৪ সালের মধ্যে চীন হাম্বানটোটা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটির জন্য পাঁচ কিস্তিতে ১.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেয়। প্রথম দিকে ঋণের সুদহার ১-২ শতাংশ ধরা হলেও পরে তা বেড়ে ৬.৩ শতাংশে দাঁড়ায় এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ সংক্ষিপ্ত করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্প চালু হলেও সেখানে জাহাজ না ভিড়িয়ে, শিপিং কোম্পানিগুলো পার্শ্ববর্তী কলম্বো বন্দর ব্যবহার করে। এ অবস্থায় ২০১৭ সালে চীনা কোম্পানিকে ১.১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরের ৮৫ শতাংশ মালিকানা দেওয়া হয়। শ্রীলংকা বন্দর কর্তৃপক্ষ চীনা কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বন্দর পরিচালনা করতে থাকে। চীন কলম্বো বন্দর নগরী প্রকল্পে ১.৪ বিলিয়ন বিনিয়োগ করে। এসব প্রকল্পের ফলে চীনের কাছে শ্রীলংকার দায় ২০২০ সালে ৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়, যদিও এসব প্রকল্প থেকে আয় বাবদ ঋণ পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। চীন শ্রীলংকাকে বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্য সহায়তা ও ১.৪ বিলিয়ন ডলারের কারেন্সি সোয়াপ সুবিধা দেয় এবং চায়না উন্নয়ন ব্যাংক ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণসুবিধা ও চীনে অবস্থিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (AIIB) ১৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়। এভাবে শ্রীলংকা চীনের ঋণ-ফাঁদ নীতির শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, চীনা ঋণ ছাড়াও শ্রীলংকা আন্তর্জাতিক বন্ডের মাধ্যমে ও অন্যান্য লগ্নিকারক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। বর্তমানে শ্রীলংকার মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫,১০০ কোটি মার্কিন ডলার।
রুবলে গ্যাস বিক্রি
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো ব্যাপক অবরোধ আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাব মোকাবিলায় ৩১ মার্চ ২০২২ রাশিয়া পশ্চিমা দেশের কাছে রুবলে গ্যাস বিক্রির ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা ১ এপ্রিল ২০২২ থেকে কার্যকর হয়। রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে হলে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে দেশটির মুদ্রা রুবলে। এ জন্য রাশিয়ার একটি ব্যাংকে বিশেষ হিসাব খুলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই দেশটি গ্যাস সরবরাহ চুক্তি স্থগিত করবে। গ্যাসের পর দেশটি নিজস্ব মুদ্রা রুবলে খাদ্য ও শস্য বিক্রির ঘোষণা দেয়।