অর্থনীতি

বাজেট ইতিবৃত্ত

বাংলাদেশে প্রথম বাজেট

৩০ জুন ১৯৭২ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশের ইতিহাসে প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। একই সঙ্গে তিনি ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের পরিমান ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশের বাজেট, উপস্থাপনে একটি ক্ষেত্রে এখনও অনন্য তাজউদ্দীন আহমদ। কারণ তিনি ছিলেন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ বাকিরা হয় অবসরপ্রাপ্ত আমলা অথবা অর্থনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী। স্বাধীনতা পরবর্তী মোট ১৩ জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা বা রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন আর ১৩তম ব্যক্তি হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট পেশ করেন।

কর্তৃত্ববাদী মুদ্রা ডলার

বিশ্ব বাণিজ্যের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রিত হয় মার্কিন ডলারের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির বৃহৎ আকারের জন্য এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে স্থায়ী মুদ্রাও মনে করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি ব্যয় মেটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে। ফলে। বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে ডলারের দাম বেড়েছে, বিপরীতে কমেছে টাকার মান।

ডলার

‘ডলার’ (Dollar) শব্দটির উৎপত্তি মধ্যযুগীয় ইউরোপে। ইউরোপের দেশগুলো দ্রুত অর্থ প্রদানের একটি আন্তর্জাতিক উপায় হিসেবে এর উৎপত্তি ঘটায় এবং প্রতিটি ইউরোপীয় জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা বান্ধব নাম দেয়। ইংল্যান্ড প্রথম এটাকে ‘ডালার’ বলতো এবং পরবর্তীতে এটি ‘ডলার’ শব্দে রূপান্তরিত হয়।

প্রতীক

ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন অধিক মাত্রায় রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করে, যাকে তাদের ভাষায় Peso de Ocho বা সংক্ষেপে Peso বলা হতো, যার অর্থ আট খণ্ড। Peso চালু করার সময় ইউরোপে রূপার সরবরাহ কমতে শুরু করে। ফলে এ স্পেনীয় মুদ্রা পেসো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রাথমিক মুদ্রায় পরিণত হয়। স্পেনীয় পেসোর আগে আরেকটি মুদ্রার বেশ সুখ্যাতি ছিল, যার নাম Joachimsthaler। সংক্ষেপে একে ডাকা হয় ‘খেলার’ নামে। আর এখান থেকেই আসে ‘ডলার’ শব্দটি। ব্যবসায়ীরা লেনদেনের হিসাব সহজভাবে লেখার জন্য পেসো শব্দটির সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহার করতে শুরু করে। এ জন্য P বর্ণের ওপরের দিকে S বর্ণ বসিয়ে একটি প্রতীক তৈরি করা হয়। একসময় প্রতীকটি বেশি ব্যবহারের ফলে P ও S মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফলে S বর্ণের সঙ্গে P বর্ণের শুধু উল্লম্ব রেখাটি টিকে থাকে। যা দেখতে বর্তমান ডলার প্রতীকের মতোই। ১৭৭০ সালে ডলারের প্রতীকটি প্রথমবারের মতো কোনো নথিতে লিপিবদ্ধ হয়। তখনো কিন্তু দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র হয়নি।

ডলারের আধিপত্য বিস্তার

বহু বছর ধরে পৃথিবীতে স্বর্ণের মানের ওপর নির্ধারিত হতো অর্থনীতি ও লেনদেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে সামরিক এবং অন্যান্য সরঞ্জাম স্বর্ণের মাধ্যমে বিক্রি করায় বিশ্বের মোট রিজার্ভের ৭০% স্বর্ণ চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। ইউরোপ তখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত। যেহেতু তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল এবং স্বর্ণের ওপর ভিত্তি করে মার্কিন ডলার স্থিতিশীল ছিল সেহেতু আর্থিক ব্যবস্থার রূপরেখা কেমন হবে, এ নিয়ে ১-২২ জুলাই ১৯৪৪ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের শহর ব্রেটন উড্‌সে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয়ী মিত্রশক্তির ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা বৈঠকে অংশ নেয়। তীব্র মতানৈক্যের পর যে রূপরেখাটি চূড়ান্ত হয়, তার নাম ছিল। ব্রেটন উড্স ফাইনাল অ্যাক্ট। মূলত ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৬ মার্কিন ডলারের বিনিময় হারতেই সকল সদস্যদেশ তাদের প্রাথমিক পার ভ্যালু হিসেবে বেছে নেয়। ব্রেটন উড্‌সে অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ডলারকে ৪৪টি দেশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে রাখতে একমত হয়। সেই থেকে ডলারের আধিপত্য শুরু ৩৭তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ডলারকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭১ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ব্রেটন উড্‌সে ব্যবস্থা বাতিল করে দিলে নতুন সংকট তৈরি হয়। যে যার মতো করে বিনিময় ব্যবস্থা অনুসরণ করা শুরু করে, বিশ্ব যাত্রা শুরু করে ফ্লোটিং (Floating) বা ভাসমান বিনিময় হারের দিকে। মার্কিন ডলার স্বর্ণে রূপান্তরের ক্ষমতা বাতিল করার এ পদক্ষেপকে বলা হয় Gold Window বন্ধ করা, যাকে অনেকে Nixon Shock বলে থাকেন। বিশ্বজুড়ে মার্কিন ডলারের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে এবং চাহিদা বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৪ সালে সৌদি আরবের সাথে একটি চুক্তি করে। এ চুক্তি অনুযায়ী, সৌদি আরবকে বাধ্য করা হয় ডলারকে সার্বভৌম বিশ্বমুদ্রা হিসেবে মেনে নিতে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি বাদশাহকে গ্যারান্টি দেয় যে, যতদিন তারা পেট্রো ডলার চুক্তি মেনে চলবে ততদিন সৌদি রাজপরিবার ক্ষমতায় থাকবে। সৌদি বাদশাহদের ক্ষমতায় থাকতে আরও একটি শর্ত দেয়, তা হলো, OPEC ভুক্ত সকল দেশকে রাজি করানো যাতে ডলার ছাড়া অন্য কোনো মুদ্রা বা স্বর্ণের বিনিময়ে তেল বিক্রি না করে।

বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

বিশ্ব অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে দুই বছরের ক্ষতি সামলে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সেই গতিকে পুনরায় মন্থর করে দিয়েছে।

সূচনা-প্রসঙ্গ

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেন বাহিনীও গড়ে তুলে তাদের প্রতিরোধ। ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। তারা একযোগে রাশিয়ার ওপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে থাকা রাশিয়ার সম্পদ জব্দ করা হয়। রাশিয়াও তাদের ওপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইতোমধ্যে এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। যুদ্ধের কারণে ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি। বিশ্বে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রত্যেকটি দেশ একে অপরের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংযুক্ত। ফলে, যেকোনো ধরনের সংঘাত বা নিষেধাজ্ঞা শুধু সেই দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য দেশের ওপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

 

জ্বালানি ও ভোজ্যতেল সংকট

রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী এবং রপ্তানিকারক দেশ। তাই যুদ্ধ শুরুর পর দেশটির তেল সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। যা এক পর্যায়ে ১৩৯.১৩ ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের পূর্বাভাস, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১২৫ ডলারে এবং ২০২৩ সালে ১৫০ ডলারে উঠতে পারে। তেলের পাশাপাশি গ্যাসের দামও আকাশ ছুঁয়েছে। ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম ৬২% পর্যন্ত বেড়েছে। ইউরোপের মোট প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার ৪৭% এবং জ্বালানি তেলের এক তৃতীয়াংশ রাশিয়া একাই সরবরাহ করে। রাশিয়া ছাড়াও নরওয়ে, আলজেরিয়া ও আজারবাইজান ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করে। ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি তার প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার ৬৫% রাশিয়া থেকে আমদানি করে। এছাড়া ইতালি তার মোট গ্যাসের চাহিদার ৪৩% এবং ফ্রান্স ১৬% রাশিয়া থেকে আমদানি করে। ইউরোপের অন্য অনেক দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদার সিংহভাগই জোগান দেয় রাশিয়া। বলা যায়, রাশিয়ার জ্বালানি শক্তিই ইউরোপের বাড়িগুলোকে উষ্ণ রাখে, কারখানাগুলো সচল রাখে আর যানবাহনগুলোকে দেয় প্রয়োজনীয় জ্বালানি। এ অবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটও সৃষ্টি করতে পারে। এরই মধ্যে পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া।

বিশ্ববাজারে সয়াবিন সরবরাহকারী শীর্ষ ১০ দেশের দুটি ইউক্রেন ও রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর পর সয়াবিনের বিশ্ববাজারে প্রভাব পড়েছে। এদিকে গ্লোবাল এস অ্যান্ড পির তথ্যমতে, সূর্যমুখী তেলের বৈশ্বিক রপ্তানির ৪৬.৯% আসে ইউক্রেন থেকে ও ২৯.৯% রাশিয়া থেকে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। (EU) সূর্যমুখী তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের বন্দরগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সূর্যমুখী তেল রপ্তানিতে দেশটি বিপাকে পড়েছে। ২৮ এপ্রিল ২০২২ ইন্দোনেশিয়াও পাম অয়েল রপ্তানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। ফলে বিশ্বব্যাপী ভোজ্যতেলের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গম ও খাদ্যশস্যের দাম। কোনো কোনো দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার প্রতিবাদে চলছে আন্দোলন, বিক্ষোভ আন্দোলন ঠেকাতে কোথাও আবার জারি হয়েছে জরুরি অবস্থা। সামনের দিনগুলোতে পণ্যের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই রেকর্ড বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) বলেছে, যুদ্ধের কারণে এ বছর বৈশ্বিক খাদ্যপণ্যের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। খাদ্যের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (WFP) প্রধান ডেভিড বিসলি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যের দাম এতটাই বেড়ে যেতে পারে যে, তা বিশ্বের দরিদ্র মানুষদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদক। কিন্তু দেশটি সম্প্রতি ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বিশ্ববাজারে এ ধাতুটির সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন উদ্বেগে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। এছাড়াও সার, নিকেল ও প্যালাডিয়াম-এর অন্যতম শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। চলমান সংঘাতের কারণে পটাশের সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হয়েছে অনেকাংশে, যা খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) মতে, জানুয়ারিতে খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক গড় মূল্যসূচক বেড়েছে ১.১%। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে সোনা, রুপা, তামাসহ মূল্যবান সব ধাতু, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বিটুমিন, বিল্ডিং ফিনিশিং আইটেম ইত্যাদি দ্রব্যসহ প্রায় সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রবন্ধ

খাদ্য ঘাটতি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ধীরে ধীরে বিশ্বে খাদ্য সংঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর অনেক মানুষ অনাহারের ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী ভুয়া ও অপুষ্টি বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্ববাজারের ২.৫% খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে থাকে। রাশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম বড় গম রপ্তানিকারক, এক্ষেত্রে ইউক্রেনের অবস্থান পঞ্চম। দেশ দুটি বিশ্বব্যাপী গম বাণিজ্যের প্রায় ৩০% সরবরাহ করে। মিসর তার গমের ৮০% এর বেশি এবং লেবানন ৫০% এর বেশি ইউক্রেন থেকে আমদানি করে। আফ্রিকার ৫৫টি দেশের মধ্যে ৩৫টিই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গমসহ অন্য খাদ্যশস্য আমদানি করে। চলমান যুদ্ধের কারণে ২০২২-২৩ সালে ইউক্রেনে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে FAO। এছাড়া দেশটির ২০% থেকে ৩০% জমি অনাবাদি থাকবে। যুদ্ধের ফলে গম ও ভুট্টার মতো বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে আছে সারের সংকট। সার উৎপাদনে ঘাটতির কারণে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারে। আর এর ফলে বিশ্বে বিরাট খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। WTO’র মহাপরিচালক বলেন, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দিয়েছিল, যুদ্ধের কারণে তা চলমান থাকবে।

 

প্রবৃদ্ধি হ্রাস

IMF’র তথ্যমতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবন্ধি 8.8% কম হবে। IMF, বিশ্ব ব্যাংক এবং ইউরোপীয় ব্যাংক এক যৌথ বিবৃতিতে জানায়, এ যুদ্ধের প্রভাব পড়বে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতেই। প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে যাবে, বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হবে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দরিদ্র ও অধিক ঝুঁকিপূর্ণরা। এদিকে যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO)। এর আগে সংস্থাটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ৪.৭% প্রবৃদ্ধির কথা বললেও এবার তা কমিয়ে ২.৫% তে নামিয়ে এনেছে। এছাড়াও WTO’র মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইওয়েলা বলেন, মধ্যম মেয়াদে বিশ্বে মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকবে। ইউরোপিয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (EBRD)-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, যুদ্ধ যদি আজকে থেমে যায়, তারপরেও আগামী কয়েক মাস পর্যন্ত এর প্রভাব রয়ে যাবে। আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্য দিয়েই সে প্রভাব অনুভব করবে বিশ্ব।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে। এর প্রভাবে দেশে পরিবহন ভাড়া ও কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর ৫০ লাখ টন ডিজেল, ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত তেল, দুই লাখ টন ফার্নেস অয়েল ও ১ লাখ ২০ হাজার টন অকটেন আমদানি করে। ৯ বছরের মধ্যে তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠায় প্রতিদিন জ্বালানি তেল বাবদ সরকারকে ১৫ কোটি ডলার লোকসান দিতে হচ্ছে। এছাড়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বাড়ারও আশঙ্কা আছে।

বাংলাদেশ অনেক পণ্যই রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গম, সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, তুলা, সরিষা, মসুর ডাল, জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে আমদানি করেছে ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের পণ্য এবং রাশিয়ায় রপ্তানি করা হয়েছে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। রাশিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংককে বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেনসংক্রান্ত সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ করার ফলে রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি হুমকির মধ্যে পড়েছে। ফলে যেসব পোশাকের অর্ডার শিপমেন্টের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, তার মূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। পণ্য আমদানির বেশির ভাগই সিঅ্যান্ডএফ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট) ভিত্তিতে হয়। ফলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়ার কারণে আমদানিকারকদের খরচ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে আমদানিকৃত পণ্যমূল্যে। আমদানি ব্যয় বাড়বে, যা বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়াবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ১,৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন ঘটছে যা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকতে পারে। এক বছরে ডলারের দর বেড়েছে ১৬%। এ অবস্থায় দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ববাজারে গম রপ্তানির বড় অংশীদার রাশিয়া ও ইউক্রেন। চলতি অর্থবছরে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে চার লাখ টন গম আমদানি করেছে। আরও দেড় থেকে দুই লাখ টন গম আমদানির টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশে গম আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে উঠে ভারত। দেশটি ১৩ এপ্রিল ২০২২ গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে। এতে বাংলাদেশের বাজারে গমের দাম বেড়ে গেছে। এই যুদ্ধের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২সহ যেসব প্রকল্পে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, সেগুলো দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়তে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক বিশাল ধাক্কা যা এখনো মহামারির প্রভাব থেকে বিশ্ব পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা এবং এক দেশ অপর দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মানার্থে এ যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।

Leave a Reply