অর্থনীতি

অর্থ-বাণিজ্য

বিটকয়েন কেনায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশে বসে ব্যাংকের কার্ড কিংবা মুঠোফোন দিয়ে কেনা যায় ভার্চুয়াল মুদ্রা বিটকয়েন ও ক্রিপ্টোকারেন্সি। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ এমন যেকোনো লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ। এতে ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান, এমএফএস প্রতিষ্ঠানসহ বৈদেশিক মুদ্রাসংশ্লিষ্ট সকলকে জানানো হয় যে, ভার্চুয়াল অ্যাসেট, ভার্চুয়াল মুদ্রা ও বিটকয়েন কেনাবেচা করা যাবে না। কারণ, এসব লেনদেনের আইনগত ভিত্তি নেই। আবার রপ্তানি আয় দিয়েও এমন লেনদেন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।

RTGS- এ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন

এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে তাৎক্ষণিক লেনদেন নিষ্পত্তির অনলাইন ব্যবস্থা Real Time Gross Settlement (RTGS)। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং ও নিষ্পত্তি এ ব্যবস্থায় শুরু হয়। ২০১৫ সাল থেকে ১ লাখ টাকার বেশি RTGS’র মাধ্যমে লেনদেন হয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে টাকার পাশাপাশি এ ব্যবস্থায় পাঁচটি বৈদেশিক মুদ্রা তথা মার্কিন ডলার, পাউন্ড, ইউরো, কানাডিয়ান ডলার এবং ইয়েন যুক্ত হবে। শিগগিরই যুক্ত হবে চীনা মুদ্রা ইউয়ান। উল্লেখ্য, ব্যাংকগুলো এই ছয়টি মুদ্রায় ক্লিয়ারিং হিসাব খুলতে পারে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ইউয়ানে ক্লিয়ারিং হিসাব খোলার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।

নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান

৩০ আগস্ট ২০২২ বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪২৪তম পরিচালনা পর্ষদের সভায় ‘নগদ ফাইন্যান্স পিএলসি’ নামে নতুন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়। নগদ ফাইন্যান্স চূড়ান্ত – অনুমোদন পেলে দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হবে ৩৬টি। বর্তমান ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২টি সরকারি। ১৯টির উদ্যোক্তা বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা ও ১৩টিতে দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া একটিতে রয়েছে সরকারি ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ।

বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ রপ্তানি

বাংলাদেশের তৈরি ৬,১০০ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন কন্টেইনার জাহাজ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তর করে আনন্দ শিপইয়ার্ড। এটি দেশে নির্মিত রপ্তানি করা বৃহত্তম কন্টেইনার জাহাজ। যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান এনজিয়ান শিপিং কোম্পানি লিমিটেড জাহাজটি ক্রয় করে। এটি ৩৬৪ ফুট লম্বা, প্রস্থে ৫৪ ফুট ও গভীরতা ২৭ ফুট। জাহাজটির ইঞ্জিনের ক্ষমতা ৪,১৩০ হর্স পাওয়ার, গতি ১২.৫ নটিক্যাল মাইল ও ধারণক্ষমতা ৬,১০০ টন। আনন্দ শিপইয়ার্ড ২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কন্টেইনার জাহাজ ‘স্টেলা মেরিস’ রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে জাহাজ রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত করে।

যুক্তরাজ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত

২২ আগস্ট ২০২২ ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন জানান, স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণের পরও যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত থাকবে। ব্রিটিশ সরকার বিদ্যমান জিএসপি-ব্যবস্থার স্থলে ‘ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ট্রেডিং স্কিম’ নামে একটি নতুন স্কিম ঘোষণা করে, যাতে LDC থেকে উত্তরণের পরও বাংলাদেশের ৯৮% পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হবে।

চীনা মুদ্রায় এলসি

প্রচলিত বৈদেশিক মুদ্রার পাশাপাশি এখন থেকে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে আমদানি দায় পরিশোধ করা যাবে। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত নির্দেশনা ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়। নতুন নির্দেশনার ফলে ইউএস ডলার, ইউরো, জাপানি ইয়েন, যুক্তরাজ্যের পাউন্ড ও কানাডিয়ান ডলারের মতো বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে লেনদেন সম্পন্ন করতে চীনের মুদ্রা ইউয়ান কিনতে ব্যাংকগুলোর অথরাইজ ডিলার (AD) শাখাগুলোকে অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এডি শাখাগুলো চীনের ব্যাংকের সঙ্গে ইউয়ান মুদ্রায় ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে। এর পূর্বে ২০১৪ সালের মার্চে একটি প্রজ্ঞাপনে ইউয়ানকে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ঋণ

বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বৃহত্তম বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী। প্রতিষ্ঠানটির সহায়তার ধরন মূলত, সহজ শর্তে ঋণ এবং অনুদান। এটি ঋণ, নীতি পরামর্শ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার পরিষেবা প্রদান করে।

বিশ্বব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা, যা বিভিন্ন দেশকে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণ, অনুদান ও পরামর্শ প্রদান করে। ১-২২ জুলাই, ১৯৪৪ যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডসের মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলে অনুষ্ঠিত ৪৫টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে গৃহীত চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয়। এ চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৫। সংস্থাটির সদর দপ্তর ওয়াশিংটন ডিসি। ১৯৪৭ সালে প্রথম দেশ হিসেবে ফ্রান্স বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করে। তখনই বিশ্বব্যাংক শর্ত দেয় ঋণ পরিশোধকালে দেশটি অন্য যেকোনো ঋণদাতার চেয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার দেবে। বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁট করতে হবে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ৫টি অঙ্গসংস্থা হলো- IBRD, IDA, IFC, ICSID ও MIGA.

পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যাংক (IBRD)

• বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি অঙ্গ সংস্থা, যা মধ্যম আয়ের এবং ঋণযোগ্য নিম্ন-আয়ের দেশগুলির সরকারকে ঋণ দেয়। যার প্রধান উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ। IBRD তে যোগদানের জন্য, দেশগুলিকে প্রথমে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) সদস্য হতে হবে। বাংলাদেশ IBRD থেকে কোনো ঋণ নেয় নাই।

• আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতি (IDA) বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি অঙ্গ সংস্থা, যা উন্নয়নশীল দেশসমূহ যাদের মাথাপিছু আয় ১,০৬৫ ডলারের নিচে, যেখানে লোকেরা দিনে দুই ডলারের কম আয় করে সেই দেশগুলিতে ঋণ প্রদান করে। IDA’র ঋণে শুধু ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৪০ বছরের পরিপক্বতা দেওয়া হয়। IDA’র ঋণে কোনো সুদ নেই, তবে এটি বিতরণ করা এবং বকেয়া ঋণের উপর ০.৭৫% বার্ষিক পরিষেবা চার্জ দিতে হয়। IDA ঋণের এবং অনুদানের প্রতিশ্রুতি চার্জ বার্ষিক ০%-০.৫%। তাই IDA কে Soft loan window বলা হয়। কারণ IDA সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়। IDA’র সদস্যপদ IBRD এর সকল সদস্যের জন্য উন্মুক্ত।

• আন্তর্জাতিক পুঁজি বিনিয়োগ সংস্থা (IPC) বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি অঙ্গ সংস্থা, যা স্বল্পোন্নত দেশগুলিতে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি খাতে ঋণ, ইক্যুইটি এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে। IFC সাধারণত ৭-১২ বছর মেয়াদে ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত প্রকল্পে ঋণ দেয়। IBRD’র সদস্যপদ IFC তে সদস্য হওয়ার পূর্বশর্ত।

• পুঁজি বিনিয়োগজনিত বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক কেন্দ্র (ICSID) বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি সালিশি প্রতিষ্ঠান ICSID সরকার এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনিয়োগ বিরোধের সমঝোতা এবং সালিশের সুবিধা প্রদান করে।

• বহুপাক্ষিক বিনিয়োগ গ্যারান্টি এজেন্সি (MIGA) বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান, যা রাজনৈতিক ঝুঁকি বীমা এবং ঋণ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা প্রদান করে। বিশ্বে প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করার জন্য Foreign Direct Investment (FDI)-এ উৎসাহ প্রদানের জন্য MIGA বিনিয়োগকারীদের ঋণ দেওয়ার গ্যারান্টি প্রদান করে থাকে।

বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের ঋণপ্রবাহ

• ১৯৭১-৭২ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ খাদ্য, পণ্য এবং প্রকল্প সহায়তাসহ মোট ১৬,১২৮ কোটি ডলার বা ১৬১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে জুন ২০২২ পর্যন্ত মোট ১০,১৩৬ কোটি ডলারের বেশি অর্থ ছাড় করেছে। ছাড় করা অর্থের মধ্যে ৩৬% বিশ্বব্যাংকের। নভেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাংক প্রথম ৫ মিলিয়ন ইমার্জেন্সি রিকভারি ক্রেডিট দেয়।

• জুন ১৯৭২-২০১৮ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ২৮, ৮৬৯ (বি.মা.ড.) ঋণ প্রদান করেছে বিশ্বব্যাংক। বর্তমানে ৫৫টি প্রকল্প বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্পে প্রায় ১,৫৬৯ কোটি ডলার দিবে বিশ্বব্যাংক।

• ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক তৃতীয় সর্বোচ্চ উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশের জন্য প্রায় ১৬৭ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা ছাড় করেছে। বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সাথে সঙ্গতি রেখে বিশ্বব্যাংক সিস্টেমেটিক কান্ট্রি ডায়গনস্টিক (SCD) ফান্ড গঠন করে।

• ১৬ জুলাই, ২০২২ Resilient Infrastructure for Adaptation and Vulnerability Reduction (RIVER) এর অধীনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান ও ঋণদানের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা সুদমুক্ত ঋণ।

• ৭ আগস্ট, ২০২২ কোভিড রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রজেক্ট শীর্ষক প্রকল্পের জন্য ৩০০ (মি.মা.ড.) অর্থায়নের চুক্তি সই করে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংক। বাংলাদেশ SDR মুদ্রায় এ ঋণ গ্রহণ করবে। বার্ষিক ০.৭৫% সার্ভিস চার্জ এবং ১.২০% হারে সুদ দিতে হবে।

• ২২ আগস্ট, ২০২২ বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ১,৫০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। অন্যদিকে, IDA স্বাধীনতার পর থেকে জুন ২০২১ পর্যন্ত তিনটি খাতে সর্বমোট ২৪,৯৭১ (মি.মা.ড.) ঋণ দেয়। খাত তিনটি হলো- খাদ্য সাহায্য, পণ্য সহায়তা ও বিভিন্ন প্রকল্প। IFC আগামী পাঁচবছরে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার দিবে। MIGA বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বছরে ৬৯৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্যারান্টি দিচ্ছে।

Leave a Reply